প্রতিটি স্মৃতিই মানুষকে কাঁদায়, হোক তা দুঃখের কিংবা সুখের। আর সেই স্মৃতিটা যদি কাছের মানুষের হঠাৎ করে চলে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি হয় অথবা হঠাৎ করে কাছে এসে আপন হয়ে কাছে আসে আবার দমকা হাওয়ায় হারিয়ে যায় তবেতো কষ্টের সীমা থাকে না। ধাবমান জীবন চলে যাচ্ছে জীবনের গতিতে। সময়কে বেঁধে রাখার কোন উপকরণ এখনো আবিষ্কার হয়নি, কখনো হবেও না। যদি সময়কে আটকে রাখা যেত তবে সুখের সময়টাকে সবাই আগলে র...াখতো পরম যতনে। তখন স্মৃতিচারণ গুলোতে কোন কষ্ট থাকতো না। চোখের কোণায় জলও দেখা যেত না। প্রত্যেকটি মানুষ হতো একেকটি সুখী মানুষ।
তখন মাহীকেও আর কাঁদতে হতো না স্মৃতির পথে হেঁটে। মাহী যেমন হঠাৎ করে বন্ধু হয়ে আসা রিয়াকে হারিয়ে তার স্মৃতিগুলোর যন্ত্রণায় কাঁদছে।
মাস ক'য়েক আগে ফেসবুকে আসমা খানম মাহীর সাথে বন্ধুত্ব হয় রহিমা আফরোজ রিয়ার। কমেন্ট, চ্যাটে জমে উঠতো তাদের আড্ডা। ইনবক্সে একে অন্যের সাথে শেয়ার করতো নিজেদের দুঃখ সুখের কথা। কোন কথাই বাদ পড়তো না। আজ ক্লাশে আমরা সবাই মিলে গল্প করতে ছিলাম, যখন ম্যাডামে ক্লাশে ঢুকলেন তখন আমরা তড়িঘড়ি করে নিজের আসনে চলে গেলাম। কিন্তু কুসুম চলে যাওয়ার সময় ব্যাঞ্চের সাথে আটকে তার জামাটা খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। সেকি লজ্জা। বেচারী অনেক শখ করে সাড়ে নয়শ’ টাকার থ্রি পিচ উনিশ’ টাকা দিয়ে কিনেছে। আবার কলেজে যাওয়ার সময় রাস্তায় কি দেখেছে তা বলতো। দুইটা বখাটেকে কিছু মানুষ ইভটিজিংয়ের দায়ে কানে ধরিয়ে দাঁড় করায়ে রেখেছে সব চলে আসতো তাদের চ্যাট ইনবক্সে। এমনকি নিজেদের ভালোবাসার মানুষদের প্রসঙ্গও টেনে এনে মজা করতো তারা। জানো, আজ আমার ওর সাথে এই এই কথা হয়েছে। ওটা একটা হাবলার হাবলা। আমি এমন ভাবে তার সাথে কথা বলছি যে সে প্রথমে বুঝতেই পারেনি আমি তার সাথে ফান করছি! সে আমার সব কথা বিশ্বাস করে বসে আছে। অথবা তোমারতো একজন আছে, আমারতো তাও নাই। একদিন কথা বলিয়ে দিওতো, দেখি তোমার ইয়ে কেমন মিচকি শয়তান! তারপর দু’জনেই হাসির ইমো বিনিময় করতো।
মাহী বশিকপুর আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে সায়েন্স গ্রুপে আর রিয়া কদমপুর কলেজে কমার্সে পড়ছে। দু’জনেই ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। পথের দূরুত্বের জন্য তাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কিছুদিনের মধ্যে মোবাইলে জমে উঠলো তাদের আড্ডা। প্রতিদিন কম করে হলেও দেড়-দুই ঘন্টা কথা হতো তাদের মাঝে। দেখতে দেখতে তাদের মাঝে একে অন্যের প্রতি একটা গভীর ভালোবাসা জন্মে গেল। একজনের কিছু হলে অন্যজন ব্যাথা পায় অথবা একের সাথে অন্যের মান অভিমান হলেই কেঁদে উঠে দু’জনই। মাহী ধীরে ধীরে রিয়ার সাথে কথা বলিয়ে দেয় তার কাছের বন্ধুদের। এমনকি মনের মানুষ ইফতেখার রহমানের সাথেও। প্রায় মোবাইলে কনফারেন্স করে তারা আড্ডা হতো।
বেশ কিছুদিন পর লক্ষ্য করা গেল রিয়া কথায় কথায় অভিমান করতে থাকে। এছাড়াও আরও লক্ষ্য করল মাহী শুধু নিজের কথাই তার সাথে বলছে, কিন্তু রিয়া তার কোন সুখ-দুখের কথা তার সাথে শেয়ার করছে না। কেমন আছো জানতে চাইলেও কাশতে কাশতে বলে, ‘ভালো আছি’।
প্রতিবাদ করে মাহী, ‘তুমি ভালো নেই, বলো কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন কাশ দিচ্ছো কেন?’
‘এ এমন কিছু না, একটু ঠান্ডা লাগছে।’ বলে রিয়া।
‘ডক্টর দেখাইছো?’ জানতে চায় মাহী।
‘হ্যাঁ, দেখাইছি।’ বলল রিয়া।
‘ঔষধ খাচ্ছোতো ঠিকমত?’ জিজ্ঞাসা করল মাহী।
‘খাচ্ছি’। জানালো রিয়া।
কিছুদিন পর খুব সামান্য একটা ব্যাপারে রিয়া রেগে গেল। তার সে কী অভিমান! মাহী অনেক চেষ্টা করলো তার অভিমান ভাঙাতে, কিন্তু সেদিন আর অভিমান ভাঙাতে পারেনি। অথচ প্রায়ই দু’জন সামান্য ব্যাপার গুলোতে অভিমান করতো, আবার কিছু সময় পরেই সে অভিমান ভেঙ্গে যেত। সেদিন খুব করে কেঁদেছিল মাহী। মাহীর মন বলছিল রিয়াও কেঁদেছিল খুব।
মাহীর যখন মন খারাপ থাকে তখন কারো সাথে সে ভালো ব্যবহার করতে পারে না। কেন করতে পারে না তাও সে জানেনা। তাইতো যখন সে রেগে থাকে তখন যদি ইফতেখারও ফোন দেয় তখন তার সাথেও রেগে কথা বলে এমনকি বকাঝকাও করে। কিন্তু ইফতেখার তাকে বুঝে বলে কখনো রাগ করে না। কষ্ট পেলেও কখনো প্রকাশ করে না কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কষ্ট যে পেয়েছে তা মাহী ঠিকই বুঝতে পারে। প্রিয় মানুষটিকে এভাবে রাগারাগি করা ঠিক হয়নি, সেওতো কষ্ট পায়। যাকে নিয়ে সে বাকি জীবন কাটানোর স্বপ্নে বিভোর। এরপর ফোনে নয়তো মুঠো বার্তায় সরি বলে দেয় তার স্বপ্নের পুরুষ ইফতেখারকে।
ইফতেখারও তাকে বেশ বুঝতে পারে। এটা মাহী বলে। ইফতেখার যখনি বুঝতে পারে মাহী কষ্টে আছে তখন তার পাশে থাকার জন্য আন্তরিকতার কমতি থাকে না। তাকে সান্তনা দেয়, তাকে মেন্টলি সাপোর্ট দেয়। এজন্যে মাহীও ইফতেখারকে পেয়ে নিজকে ধন্য মনে করে আর তাকে সারাজীবন এভাবে পাশে পাওয়ার স্বপ্ন বুনে।
বেশ বদলে গেছে রিয়া। এখন আর আগের মত কথা বলতে চায় না সে। বেশির ভাগ সময়েই চুপচাপ থাকে। ধীরে ধীরে মাহীর সাথেও যোগাযোগ কমিয়ে দেয় রিয়া। অন্যদিকে মাহীও তার সাথে কথা বলতে না পেরে পাগল প্রায়। এরিমধ্যে একদিন হঠাৎ করে রিয়া মোবাইল বন্ধ করে দেয়। তার কোন খোঁজ খবরও পাচ্ছে না মাহী। ফেসবুকে তার বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না।
এভাবে একদিন, দু’দিন, তিনদিন করে প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে, কিছুতেই মনকে স্থির করতে পারে না মাহী। কেন সে এসেছিল তার জীবনে পরম বন্ধু হয়ে, আর হঠাৎ করে কেনইবা কিছু না বলে এভাবে হারিয়ে গেল? হারিয়েই যদি যাবে তবে এতটা কাছে আসার কি দরকার ছিল? সময় যত গড়াতে থাকে তার প্রতি তার টান আরো বাড়তে থাকে। পড়াশোনায়ও মন বসাতে পারে না মাহী। কোথায় আছে কেমন আছে রিয়া? সে ঠিক আছেতো? এমনিতেই সে কিছুদিন থেকে অসুস্থ। আল্লাহ না করুক তার কিছু হয়ে যায়নিতো? কিছুতেই কিছু করতে পারছে না মাহী। খাওয়া দাওয়াও এক রকম ছেড়ে দিয়েছে সে।
ফেসবুকে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। একদিন ফাইজা তাবাস্সুম নামে রিয়ার এক বন্ধুর সাথে মাহীর আলাপ হলো। আলাপের পর যা জানা গেল তার সারাংশ হলো- রিয়ার কিছুদিন থেকে বদলে যেতে শুরু করেছে। সে আর আগের মত কারো সাথে কথা বলে না, কাউকে আর আগের মত সময় দেয় না, এমনকি মা-বাবার সাথেও খুব একটা কথা বলে না। অনেকটা একঘরে হয়ে গেছে সে। সামান্যতেই রেগে যায়। একাকী থাকতে পছন্দ করে, আর কি যেন সব ভাবে। মাঝে মাঝে একা একাই কাঁদে আবার একা একাই হাসে। ফাইজা আরো জানালো, রিয়া অনেক দিন থেকে অসুস্থ ছিল। কিন্তু তার পরিবার সে দিকে কোন ভুক্ষেপ করেনি। তাই একদিন নিজেই ডাক্তারের কাছে গেছে। কি কি যেন টেস্ট করিয়েছে। রিপোর্ট গুলি নিয়ে বাসায় এসে আমাকে ফোন দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল। কান্নার জন্য ঠিকমত কথা বলতে পারেনি। শুধু এটুকু বলছে, ‘ফাইজা অনেক সময় তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস’। আরও জানালো তার কিছু ভালো লাগছে না। যত দিন যাচ্ছে তার শরীরটা নাকি কেমন যেন জড়ো সড়ো হয়ে আসছে। স্মৃতিগুলোও কেন যেন হ্রাস পাচ্ছে। চোখের সামনের সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছে? কিন্তু কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে ফেলছে। পরদিন আমি দেখা করতে গেলে আমার সাথেও দেখা করেনি। তার মায়ের নাম্বারে ফোন করে কথা বলতে চেয়েছি, কিন্তু আমাকে বলে দিয়েছে আমি যেন তাকে আর ফোন না করি। ফোন করলে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে।
মাহী ফাইজাকে অনুরোধ করলো কিছু একটা করার জন্য। ফাইজা বলল, চেষ্টা করছি দেখি কি করা যায়। মনে হয় না কিছু করতে পারবো। দোয়া রাখেন।
মাহী নিজকে আর কিছুতেই মানাতে পারছে না। কি হয়েছে রিয়ার? কেন সে এমন করছে? তার মা-বাবাও বা কেন এমন আচরণ করছেন? রিয়ার বড় কোন এক্সিডেন্ট হয়নিতো? সে কি কোন দূরারোগ্য রোগে ভূগছে? সেকি আগে থেকেই জানতো তার এই রোগ হয়েছে? এজন্যই কি সে কাউকে তার জীবনের সাথে জড়াতে চায়নি? কারো সাথে রিলেশন পর্যন্ত করেনি?
কি আবোল তাবোল ভাবছে মাহী। সে সুস্থ আছে। তার কিছুই হয়নি। মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না মাহী। রিয়ার মতো ভদ্র, নম্র স্বভাবের একটা স্মাট মেয়ের মনে এতটা কষ্টের বসত, অথচ সে তার ভালো বন্ধু হয়েও জানতে পারেনি! রিয়াওতো কখনো বলেনি তাকে এমন কিছু! এ কেমন মেয়ে? যে নিজের কথা বলতে চায়না!
আমি তোমাকে ভালোবাসি রিয়া। সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি ফিরে এসো প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না। তোমাকে অনেক অনেক মিস করছি। প্লিজ জান পাখি আমার, আমাকে আর এভাবে কষ্ট দিও না। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ থেকে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছে মাহী খেয়াল করেনি। মনকে কিছুতেই বুঝাতে পারছে না মাহী। সে কি করবে? তার কি করা উচিত? কিভাবে তার খোঁজ খবর নেওয়া যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ৩টা বাজে।
পুকুর ঘাটের এই পাশটায় সুপারি গাছের মাচা তৈরি করা হয়েছে বাতাসে বসার জন্য। এখানে বসলে শরীরটা জুড়িয়ে যায়। মাহী এখানে বসে আছে রাত প্রায় ৯টা থেকে। আজ রাতের খাওয়াও হয়নি। মা কয়েকবার ডেকে গেছেন কিন্তু একটু পরে আসছি বলে আর যায়নি।
বসা থেকে উঠলো মাহী। ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছলো। তারপর শান বাঁধানো ঘাট দিয়ে নিচে নেমে গেল অজু করার জন্য। আজ তাহাজ্জুদ নামাজ পড়বে সে। বন্ধুর জন্য। বন্ধুকে ফিরে পাবার জন্য। বন্ধুর সুস্থ্যতার জন্য। অন্তরে একটাই বিশ্বাস। রিয়া ফিরে আসবে। সুস্থ হয়েই ফিরে আসবে।
1 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন