নির্জন আঁধার তিমির রাত্রি। ঝির ঝির করে দখিনা হাওয়া বইছে। পাশের ঝোপ-ঝাড় থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। মিটি মিটি আলো ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে জোনাকি। আকাশে তারারা মুক্তার মত জ্বল জ্বল করছে। কি অপরুপ মন কাড়ানো, চোখ জুড়ানো রাত্রি। এ দৃশ্য মনকে বার বার দোলায়িত করে। মন হয়ে ওঠে চঞ্চল। পুকুর পাড় থেকে কয়েক কদম দূরেই ফসলের মাঠ। মৃদ্যু বাতাসে মাঠের সবুজ ধান গাছ খেলা করছে। হালকা চাঁদের আলোয় বেশ লাগছে। এক সময়ের বিশাল মাঠটা এখন অনেকটা ছোট হয়ে আসছে। নতুন করে দুইটি বাড়ি হয়েছে মাঠের পশ্চিম দিকে। পূর্ব পাশে বিশাল বাগান বাড়ি। মাঠের দণি পাশ ঘেঁসে একটি খাল। উত্তর পাশে ইমুদের বাড়ি। ইমুদের বাড়ির এ পাশটা বেশ দৃষ্টি নন্দন। রাতের দৃশ্যতো আরো সুন্দর। দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পুকুর পাড়ে থাকা আম গাছের একটা ডাল এদিকে বাঁকা হয়ে এসে বসার আসন তৈরি করে দিয়েছে। এজন্য এখানে প্রায়ই ইমু তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিত। এখন ইমুর বন্ধুরা যে যার মতো করে ব্যস্ত। ইমুও একটা ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এজন্য এখন আর আড্ডা হয়না বললেই চলে। আজ ইমু এ গভীর রাতেও বসে আছে একাকি। কেন বসে আছে সে? সে কি ভাবছে? সে কি উপভোগ করছে অন্ধকার রাতের স্বিগ্ধ শোভা? যদি তাই হয় তবে তার চোখে পানি কেন? দু’টি গাল বেয়ে ঝরে চলছে অশ্রুধারা ঝরণার মত। কিসের এত কষ্ট তার? মনে হয় যেন ভারী পাথরের তলে চাপা পড়েছিল এই কষ্ট। যে কষ্ট প্রকাশ করতে পারছেনা সে। আবার সহ্যও করতে পারছেনা। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে শুধু এই অশ্রুধারার মধ্য দিয়ে।
গত বছরের কথা। বর্ষার মাঝামাঝি। সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছে ইমু। হাঁটছে আর মানুষ জনের আনন্দ, ছুটোছুটি, ঢেউয়ের মাঝে আছড়ে পড়া দেখছে। পানির ঢেউ গুলো পা ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। মনের মাঝে একটা পুলকিত ভাব সৃষ্টি হচ্ছে। ঢেউয়ের নাচনের দারুন সুর মনের মাঝে একটা আবহ তৈরি করেছে। এই তৃতীয় বারের মত সমুদ্রকে খুব কাছ থেকে দেখা হচ্ছে। ‘সমুদ্র- পাহাড়- প্রকৃতি’ এ তিন সব সময় আকর্ষণ করে ইমুকে। এসবের কাছে গেলে খাওয়া দাওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। ইমুর খুব বেশি ভ্রমণ করার সুযোগ হয়নি কোন না কোনো কারণে। কিন্তু এখন আর সুযোগ পেলে হাতছাড়া করতে চায় না। যেভাবেই হোক সময় বের করে নেয়। তাই সুযোগ পাওয়ায় কোম্পানির সেমিনারে কক্সবাজার সফর। সেমিনারে যোগদান হলো- সেই সাথে সমুদ্রের পাড়েও হাটা হলো। বছর খানিক আগে কাছ থেকে পাহাড় দেখে গেছে চট্টগ্রাম থেকে। নানা কথা ভাবছে আর হাঁটছে ইমু। হঠাৎ পেন্টের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনের কম্পনে তার সম্ভিত ফিরে এলো। কেউ তাকে ফোন দিয়েছে। সে ফোনটা রিসিভ করলো। সাধারণতঃ ইমু কখনো অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলে দু’তিন বারের আগে রিসিভ করে না। কিন্তু এটি অপরিচিত নাম্বার হওয়ার পরও সে প্রথমবারেই ফোনটি রিসিভ করল। ফোনটি একটি মেয়েলি কন্ঠে কথা বলে উঠল- ‘এই কলটির চার্জ পরিশোধের জন্য কলার আপনাকে অনুরোধ করেছেন, রাজি থাকলে এক চাপুন- না থাকলে দুই চাপুন’। এই কলগুলো কখনোই ব্যাক করেনা ইমু। কিন্তু আজ কি মনে করে সে এক চাপলো। কলটি ব্যাক হয়ে গেলো, কিন্তু আবারো সেই কণ্ঠটি কথা বলে উঠল- ‘আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহ করে ........’। লাইনটি কেটে দিয়ে মোবাইলটি পকেটে রাখে ইমু। আবারো ফোনটিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। রিসিভ করার পর সে একই কথা- ‘এই কলটির ............’। এইবার আর এক চাপেনি ইমু। লাইনটি কেটে সরাসরি ফোন দিলো । দ্বিতীয় চেষ্টায় সংযোগ পাওয়া গেলো। ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে ভেসে এলো- ‘আস্সালামু আলাইকুম’।
- ওয়ালাইকুম সালাম।
- ভাইয়া কেমন আছেন ?
- আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল। আপনি কেমন আছেন ? জিজ্ঞেস করলো ইমু।
- ভাল আছি। বাসায় সবাই কেমন আছেন ?
- জ্বি ভাল।
ওপাশের কণ্ঠ আর কথা বলার স্টাইলে মনে হচ্ছে কণ্ঠটি তার বেশ পরিচিতি। তারপরও শিউর হবার জন্য জিজ্ঞেস করলো- ‘কে বলছেন প্লিজ ?
মেয়েটি আমতা আমতা করে বললো, ‘আ-পনি কি সফিক ভাইয়া না ?’
- সরি, আমি ইমরান মুহাম্মাদ বলছি।
- সরি ?
- আমি ইমু।
- ইমু! কই থেকে ভাইয়া ?
- কক্সবাজার থেকে।
- আপনি কক্সবাজার ?
- হ্যাঁ, আমি কক্সবাজার। আপনি কোথায় ফোন করছেন ?
- আমিতো রায়পুর ফোন করছি।
- হ্যাঁ, আমিতো রায়পুরেই থাকি! কক্সবাজার বেড়াতে এসেছি।
- ভাইয়া আপনি মনে হয় আমার সাথে দুষ্টুমি করছেন।
- আমি আপনাকে চিনিনা। শুধু শুধু কেন দুষ্টুমি করতে যাবো!
- আচ্ছা বলেনতো রায়পুর কোথায় ?
- সেকি! আপনি রায়পুর কোথায় তা জানেন না অথচ রায়পুরেই ফোন করছেন? রায়পুর তো রায়পুরেই!
- না মানে আমি রায়পুর কোন জেলায় তা জানতে চাচ্ছি।
- আপনি কি রায়পুরেই থাকেন? জবাব না দিয়ে জানতে চায় ইমু।
- হ্যাঁ।
- রায়পুর শহরেই বাড়ি ?
- না।
- তবে? কত নং ইউনিয়ন?
- ৭নং।
- তার মানে বামনী ?
মেয়েটি কোন জবাব না দিয়ে মিষ্টি শব্দ করে হাসলো। তারপর বলল- ‘আপনি কে বলেন তো?’
- বললাম না আমি ইমু! আপনি কার কাছে ফোন করেছেন?
- আমি আমার এক ভাইয়ার কাছে ফোন দিয়েছি। আচ্ছা আপনি কি করেন?
- সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছি আর আপনার সাথে কথা বলছি।
- প্লিজ ভাইয়া আমি জানতে চাচ্ছি আপনি পড়েন কিনা?
- পড়ি।
- কিসে পড়েন?
- পত্রিকায়, ওয়েব সাইটে...
কথা শেষ করতে না দিয়ে মেয়েটি অনেকটা আবদারের সুরে বললো- প্লিজ ভাইয়া, আপনি কোন কাসে পড়েন, বলুন না!
- ও তাই বলেন! আমি আসলে কোন কাসেই পড়িনা।
- না ভাইয়া, আপনি মিথ্যা বলছেন!
- ‘আমি মিথ্যা বলবো কেন? আপনাকেইতো আমি চিনিনা! তাছাড়া মিথ্যা বলে লাভই বা কি? আমি একটা ব্যাপার বিশ্বাস করি। সত্য বলার সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো পরে কষ্ট করে মনে করা লাগেনা আগে কি বলছি’। অনেকটা অভিমানের সুর বেরোয় ইমুর মুখ থেকে। তারপর মেয়েটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে- ‘আপনার নাম কী ?’
- রুনা।
- রুমা ? ইমু ঠিকমত না বুঝতে পেরে আবারো জিজ্ঞেস করলো।
- হ্যাঁ।
- কোন কাশে পড়েন ?
- ইন্টার ফাস্ট ইয়ার।
- কোন কলেজ ?
- মডেল কলেজ।
মেয়েটি কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ইমু বলে উঠল- ‘সেমিনারের সময় হয়ে গেছে। এখন রাখি, পরে কথা হবে’।
- ওকে, ভাল থাকবেন।
- ‘আপনিও ভাল থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।’ ইমু ফোন কেটে দেয়।
সেদিনই প্রথম কথা হয়েছিল। ওইদিন আরো দু’বার কথা হয় তাদের মধ্যে। ইমু এমনিতে কাউকে মিস কল দেয় না। তার দৃষ্টিতে কোন কারণ ছাড়া মিসকল দেয়াটা এক প্রকার অভদ্রতা। কিন্তু সেই নাম্বারে কয়েকটি মিসকলও দিয়েছে কি মনে করে! ভাবতেই অবাক লাগে!
দু’দিন থাকার পর বাড়ি ফেরার পথেও নাম্বারটিতে একটি মিসকল দেয় ইমু। বিকেলে ওই নাম্বার থেকে মিসকল পেয়ে নাম্বারটিতে ফোন দিলে ফোন ধরে তার ফুফু।
ইমু তাকে সালাম দেয়, ‘আস্সালামু আলাইকুম।’
- ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন ?
- জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভাল। আপনি কেমন আছেন ?
- ‘ভাল।’ বলল ওপাশ থেকে।
কুশল বিনিময়ের পরে ওপাশে থাকা মেয়েটি বলল- ‘আপনি যার সাথে কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছেন আমি সেই নই, আমি তার ফুফু।’ কিছুণ থেমে ওপাশ থেকে আবার বললো- ‘আপনি যে মিসকল দেন ওর মা ওরে বকে।’
- ‘কিন্তু আমিতো মিসকল না পেলে মিসকল বা ফোন করিনা। এখনও মিসকল পেয়ে ব্যাক করছি! তাহলে কি আপনিই মিসকল দিয়েছেন?’
ইমুর কথার কোন উত্তর না দিয়ে ওপাশ থেকে আবার বলল- ‘এভাবে আর কখনো ফোন দিবেন না।’
- ‘ঠিক আছে।’ ফোন কেটে দিল ইমু। আর কখনও নাম্বারটিতে মিসকল বা ফোন দেয়নি সে। নাম্বারটি থেকে কয়েকটি মিসকল এলেও ব্যাক করেনি। ফোন দিলেও রিসিভ করেনি।
এর কিছুদিন পরে অফিসে মন দিয়ে কাজ করছিল ইমু। সেলফোনটি একটি বিপ দিয়ে কেঁপে উঠল। নাম্বারটির প্রথম আর শেষ দেখে রেখে দিল। দ্বিতীয়বারে ফোনটি রিসিভ করে।
- ‘আস্সালামু আলাইকুম’। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো।
- ‘ওয়ালাইকুম সালাম ওয়ারাহ্মাতুল্লাহ। জবাব দিল ইমু।
- ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করল ওপাশ থেকে।
- জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। ভাল। আপনি কেমন আছেন ?
- ‘ভালো’। বলল ওপাশ থেকে। এরপর জিজ্ঞেস করে- ‘আমাকে চিনছেন ভাইয়া?’
- ‘সরি’। চিনতে পারিনি।
- ‘সেকি! আমায় ভুলে গেলেন?’ অনেকটা অবাক হয়ে জানতে চায় ওপাশ থেকে।
ওপাশের কথা শুনে মনে হয় কণ্ঠের মানুষটির সাথে আগেও কথা বলেছে। ঠিক মনে করতে পারছেনা। কিছু সময় পর ইমু বলল- ‘সরি, ঠিক মনে পড়ছেনা।’
- ‘আমি রুনা।’ এবার চিনতে পারছেন?’
- ‘রুনা... রুনা...।’ কয়েকবার উচ্চারণ করে মনে করার চেষ্টা করল ইমু।
- ‘আপনি আমায় ভুলে গেলেন?’ বেশ অবাক হয় রুনা।
- ‘সরি’।
- ‘আপনি কক্সবাজার গিয়েছিলেন। সেখানে...’। কথা শেষ করতে দেয়নি ইমু। অনেকটা জোর দিয়ে বলল- ‘আপনি! আমাকে এখনো মনে রেখেছেন!’ ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ এলো।
- ‘আপনিতো আমায় ভুলেই গেছেন।’ অনেকটা অভিমানী সুরে বলল রুনা।
কিছু সময় তাদের ফোনালাপ হলো। এরপর তাদের মাঝে প্রায়ই কথা হতো। সপ্তাহের একদিন নির্দিষ্ট সময়ে ফোনের জন্য অপেক্ষা করতো ইমু। একসময় সপ্তাহে দুইদিন, তিনদিন... এভাবে প্রতিদিন। কিছুদিনের ব্যবধানে প্রতিদিনই কয়েকবার কথা হতো তাদের মাঝে। ততদিনে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব অনেকটা গভীরে চলে গেছে। একের প্রতি অন্যের বিশ্বাসটাও জন্মে গেছে ইতিমধ্যে।
রমজান ঈদের আগের দিন রাত। দীর্ঘ সময় কথা হয় তাদের মধ্যে। কথাবার্তার এক সময়ে ইমু জানতে চায় ‘আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো। উত্তর পাবোতো ?’
- ‘করো।’
- ‘তুমি কি আমায় ভালোবাস?’
রুনা ইমুর এ প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি। ইমু উত্তরটাকে ‘হ্যাঁ’ হিসেবে ধরে নিয়ে বললো- ‘দেখো, আমি এখন এসব নিয়ে ভাবছি না। আমি এখনো নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।’ সেদিন রুনা কিছু না বললেও ধীরে ধীরে ইমুর প্রতি দুর্বলতা বাড়তে থাকে। ইমু বার বার রুনাকে বুঝাতে থাকে ‘আমাদের মাঝে খুব ভালো একটা বন্ধুত্ব আছে। আমি চাই আমাদের সেই বন্ধুত্বটাই থাকুক।’ এজন্য প্রায়ই ইমু তার সাথে কথা বলার সময় ‘আন্টি’ পর্যন্ত সম্বোধন করেছে যেন সম্পর্কটা অন্য দিকে মোড় না নেয়। ইমুর মুখে ‘আন্টি’ সম্বোধন শুনে রুনা একেবারে কেঁদে ফেলত। বারবার তার ভালোবাসা ইমুকে বোঝানোর চেষ্টা করতো। যে কোন উপায়েই সে ইমুকে পেতে চায়। এজন্য ইমু প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো- ‘তুমি কি আবেগ দিয়ে চাইছো না তো?’ আবার বলতো ‘তুমিতো আবেগ দিয়ে আমাকে ভালোবাসো। আবেগটা চলে গেলে দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে।’ এতে রুনা অনেকটা আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠেই বলতো, ‘আমি সত্যিই আমার মন থেকে তোমায় ভালোবাসি। আমি তোমাকে আমার জীবন সঙ্গীনি হিসেবে চাই। আমি তোমার বুকে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে চাই। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।’ নানা ভাবে চেষ্টা করেও ইমু রুনাকে ফেরাতে পারলোনা। শেষ পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্ব ভালোবাসায় মোড় নিল। রুনা প্রায়ই বলতো- ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবোনা। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। তোমার ভালোবাসা আমি অন্য কাউকে দিতে পারবো না।’ আবার কখনো কখনো বলতো, ‘আমি কখনো অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। আমি শুধু তোমাকে চাই। আর কিছু চাইনা। শুধুই তোমাকে...।’ ইমু তার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে। বলে আমাকে সময় দিতে হবে। মাঝে মধ্যে জানতে চায়, ‘এ কি করে সম্ভব?’ আবার কখনো জানতে চায় ‘তুমি আমাদের পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার জন্য আমাকে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারবা?’ উত্তরে রুনা ‘আমি কিছু জানিনা’ বলেই কথাটাকে শেষ করতো।
ঈদের দু’দিন পর তাদের প্রথম দেখা হয়। তাদের মোট তিনবার দেখা হয়েছে তাদের স্বল্প দীর্ঘ সম্পর্কে। আর শেষ বার দেখা হয়েছে তাদের নয় মাসের মাথায়। রুনার বিয়ের কিছুদিন আগে। ইমু তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এসেছিল। বাড়িতে গিয়ে দেখা করার দ্বিতীয় দিন থেকে রুনার কথা-বার্তা অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যায়।
- ‘আমি কি করবো? আমার পরিবার আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবে না।’ অনেকটা হতাশা কণ্ঠে বলল রুনা।
- ‘কেন? আবার কি হলো?’ জানতে চায় ইমু।
- ‘আমাকে এবার বিয়েই দিয়ে দিবে। আব্বুর অবস্থা ভালো না। আব্বু তার মেয়ের জামাইকে দেখে যেতে চান।’ বলল রুনা।
- ‘আমার কথা জানাও তোমার আব্বু-আম্মুকে।’
- ‘আমি বলতে পারবোনা। আমাকে মেরেই ফেলবে।’
- ‘মেরে ফেলার কি আছে?’ জানতে চায় ইমু।
- ‘তুমি আমার ফ্যামিলিকে জানো না। যদি শুনে যে তাদের মেয়ে প্রেম করছে তবে আব্বু হার্টফেল করেই মারা যাবে। আব্বু আগেও দু’বার স্টক করেছেন। তারা কখনো চিন্তাও করেনি আমি এরকম কিছু করতে পারি।’
- ‘তবে করছো কেন?’
- ‘জানিনা।’
- ‘বাদ দাও। এখন যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান কি? আমাকে কি করতে হবে?’
- ‘আমি জানিনা।’
- ‘তুমি কি করতে চাও?’
- ‘আমি আমার ফ্যামিলির সিদ্ধান্তই মেনে নিবো। তারা সব সময় আমার ভালো চায়। আমাকে এতবড় করার জন্য তাদের অবদানই সব। আমি তাদের মনে কষ্ট দিতে পারবো না।’ এই কথা শোনার পরও ইমু নিজকে সহজে ভেঙ্গে পড়তে দেয়নি। তার ভালোবাসা, তার হৃদয়ের আকুলতা রুনাকে বুঝাতে থাকে। কিন্তু রুনা এ অবস্থার জন্য ইমুকে দায়ী করে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে, ‘আমি চাইনা আমাদের জন্য আব্বুর কিছু হোক। যার জন্য আমাদেরকে সবসময় অশান্তিতে থাকতে হবে। আমি সত্যিই তোমায় অনেক ভালোবাসি। তোমাকে আমার হৃদয়ের যে আসনটাতে বসিয়েছি সে আসনটাতে অন্য কাউকে বসাতো পারবোনা। তোমাকে যতটা ভালোবেসেছি ততটা ভালোও কখনো কাউকে বাসতে পারবোনা। আমি আমার ফ্যামিলির পছন্দে অন্য ছেলেকে বিয়ে করবো। তার অধিকার আর প্রাপ্যও তাকে দেব। কিন্তু তাকে কখনো আমি এতটা ভালোবাসতে পারবোনা, যতটা তোমাকে ভালোবেসেছি।’
- ‘কিন্তু আমার কি হবে? কেন আমাকে তখন বাধ্য করছো তোমাকে ভালোবাসতে।’ অনেকটা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ইমু। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করলো- ‘তুমিতো জানতে তোমার ফ্যামিলি আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না। তবে কেন এটি করলে?’
- ‘তখন আমি অনেকটা আবেগ দিয়ে চিন্তা করেছি।’
- ‘কেন? কেন তুমি আবেগ দিয়ে চিন্তা করেছো? যখন আমি বলছিলাম তুমি আবেগ দিয়ে চাচ্ছো তবে কেন তুমি তা মনের কথা বলেছো? কেন আবেগটা অস্বীকার করেছো?’
রুনা এবার অনেকটা শব্দ করেই কাঁদতে লাগলো। ‘আমি তখন ছোট ছিলাম। এভাবে চিন্তা করতে পারিনি।’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ইমু বলল, ‘তখন ছোট ছিলে আর হঠাৎ করে খুব বড় হয়ে গেছো!’
- ‘প্লিজ রাগ করোনা। আমি কথা দিচ্ছি তোমার সাথে আমি সবসময় যোগাযোগ রাখবো। তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বটা টিকে থাকবে। আমি তোমার মতো দ্বিতীয় কাউকে পাইনি। আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি। এ ভুলে কোন ক্ষমা নেই। অনেক বড় অপরাধ করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি কখনই সুখে থাকতে পারবো না। আমি তোমাকে নিয়েই সুখি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে তা রাখেনি। তোমার মত বন্ধু পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার।’ কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলল- ‘আম্মু ডাকছে। আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো। প্লিজ রাগ করোনা। আমার এ ছাড়া কিছু করার ছিলোনা। তোমাকে কষ্ট দেবার কোন ইচ্ছে আমার নেই।’
- ‘আমি তোমায় চাই। দেখো কিছু করা যায় কিনা।’
কথা শেষ করতে না দিয়েই ফোন কেটে দেয় রুনা।
দুই দিন কোন কথা হয়নি তাদের মাঝে। ইচ্ছে থাকলেও ইমু রুনাকে ফোন করতে পারেনি। রুনার নিজের কোন মোবাইল ছিলো না। ইমু দিতে চেয়েছিল কয়েকবার কিন্তু রুনা নেয়নি। ছটফট করতে থাকে ইমু। সহ্য করতে না পেরে ইমু পরদিন দিন সকালে রুনার মায়ের মোবাইলেই কল করে। কল ধরে রুনা। কয়েক মিনিট কথা বলার পর ইমু যা জানতে পারে তার সারমর্ম হচ্ছে- ‘তিনদিন আগে ঢাকা থেকে একটি ছেলে এসে দিনে দিনে তাকে বিয়ে করে। ফ্যামিলির চাপে রুনা তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। ইমুকে ফোন করতে চেয়েছিল রুনা। কিন্তু সে সুযোগ পায়নি। ছেলেটির সম্পর্কে আগেও একটু শুনেছিল ইমু। ছেলেটি ইমুর মতই ব্যবসা করে।’
ইমু কিছু বলতে পারেনি। শুধু একটি গামছা ভিজিয়েছে মাত্র।
- ‘ইমু। ইমু!’ মায়ের ডাকে স্মৃতির জগত থেকে ফিরে আসে ইমুর। ইমু তাড়াতাড়ি তার চোখ মুছে মায়ের দিকে ফিরে তাকায়। মা আবার বলতে লাগল, ‘এত রাত পর্যন্ত এখানে বসে আছিস কেন? টেবিলের উপর খাবারও দেখি পড়ে আছে। তোর কি কোন কারণে মন খারাপ?’ পাশে বসে ইমুর মাথায় হাত রাখে মা। মাথায় হাত রাখাতে অন্তর থেকে কান্নার বেগ অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সাগরের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে এখনি বন্যায় ভেসে যাবে পুরো গ্রাম। কিন্তু তার পরও মনকে শক্ত করে ইমু। কাঁদা যাবেনা। মাকে বুঝতেও দেয়া যাবে না কতটা কষ্টে আছে ইমু। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হয়ে বলল- ‘এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে। আজকের রাতটা অনেক সুন্দর। আপনি যান। আমি আর একটু বসি।’ ইমুর মন চাচ্ছে মাকে কষ্টটা বলে। শেষ পর্যন্ত বলতে পারেনি। মা ছেলেটার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে! কতদিন পর আজ আবার সে মা’র এই আদরটা পাচ্ছে।
রুনার বিয়ে হয়েছে আজ ছয় মাস পার হতে চলল। কিন্তু মন থেকে একটুও তাকে ঘৃণা করতে পারেনি ইমু। অনেকবার চেষ্টা করেছে ভুলে যেতে। তাতেও লাভ হয়নি। এখন আর তাকে ভুলতে চায় না। রুনা প্রায়ই ফোন করে সুখ-দুঃখের কথা বলে ইমুকে। ইমু জানতে চায়- ‘তুমি কি আসলে সুখি?’। রুনা অনেকটা চাপা কষ্ট লুকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি আসলে অনেক সুখি।’ রুনা সুখি বললেও আসলে সে সুখে নেই। এটা ইমু ভালোভাবেই বুঝে।
রুনার বিয়ের পর এতগুলো দিন চলে গেলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেনা ইমু। কোন কাজেই সে মন বসাতে পারছেনা। পারছেনা একটু মন খুলে হাসতে। মনে হয় তার মাঝ থেকে তার প্রাণ হারিয়ে গেছে। তার মনের মাঝে কিসের এক শূণ্যতা কাজ করছে। এতে দিন দিন অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে। কারো সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনাও করতে পারছেনা । যে বন্ধুদের সুখে-দুখে তাদের পাশে থেকেছে, অন্যের দুঃখকে নিজের করে নিয়েছে, অন্যের না বলা কষ্টগুলো বুঝে তাকে সময় দিয়েছে, কষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করেছে আজ তারাও ইমুর মানসিক অবস্থা বুঝতে চাচ্ছেনা। ইমুর হাসির আড়ালে কান্নাটা কেউ দেখেনা। ইমু মুখ খুলেও কাউকে কিছু বলতে পারছেনা। অথচ বার বার মন চাচ্ছে কাউকে কথাগুলো বলে মনকে হালকা করতে। কিন্তু কে শুনবে তার কথা! যে যার মতো করে ব্যস্ত।
না আর ভাবতে পারছেনা ইমু। এভাবে আর চলতে দেয়া যায়না। জীবনটাকে এভাবে থামিয়ে রাখার কোন মানে হয়না। তাছাড়া তার এই কষ্টের সময়ে যাকে পাশে পাওয়া গেছে, নিজের শত ব্যস্ততার মাঝেও ইমুকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেছে। কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে সেও চায় এ অবস্থার পরিবর্তন হোক। কিছুদিন আগে বন্ধু হয়ে পাশে আসে ইতি। ইমুর না বলা কথাগুলো ইতি খুব সহজেই বুঝে। কাউকে খুব সহজে বুঝার অদ্ভুত একটা গুণ রয়েছে মেয়েটির মাঝে। না বলা কথা গুলো তার ভালোবাসা দিয়ে বের করে নিয়েছে সে, যা ইমু আগে কাউকে বলেনি। যখনি কোন না কোন কষ্টে থাকে তখনি মেয়েটি তাকে ফোন করে নয়তো মেসেজ করে। এখনো হয়তো ঘরে গিয়ে দেখবে মেয়েটির অনেকগুলো কল আর মেসেজ জমা হয়ে আছে। এজন্যও ইতিকে ভালো লাগে ইমুর। মেয়েটির অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে বেশ অবাক হয়। সেও চায় ইমুর মাঝে আবারো সেই প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসুক। ইমুর দুঃখেও সে সমহারে দুঃখ পায়। ইমুকে বুঝায় একটা ঝড়ের জন্য সব স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রতিভাগুলোকেও মেলে ধরতে হবে। ইমুও বুঝে তার গুটিয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে আবারো মেলে ধরতে হবে। কিন্তু সেকি পারবে তার আগের জীবনে ফিরে যেতে? পারবে সব কিছুকে আগের মত করে নিতে? তার কাজগুলোকে আগের মতো ভালোবাসতে? তার হ্রাস পাওয়া অস্তিত্বকে আবারো মেলে ধরতে? মানুষজন তাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে তার উত্তম প্রতিদান দিতে? সে কি পারবে তার ধূসর আর মলিন হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে ঝেড়ে নতুন করে সাজাতে? না। আর ভাবতে পারছেনা ইমু। তাকে যে পারতেই হবে। অন্তত এই বন্ধুদের জন্য। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল ইমু। বলতে লাগলো- ‘মা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি।’ ছেলের হঠাৎ এই আচরণের কারণ বুঝতে পারেনি রহিমা আফরোজ। শুধু চাঁদের আলোয় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে। ‘চলো মা, ঘরে যাই।’ মা-ছেলে উঠে দাঁড়ায়। মাকে জড়িয়ে ধরেই মায়ের কাঁধে মাথাটা রেখে ঘরের দিকে হেঁটে যায় ইমু। পিছনে পড়ে থাকে অতীত স্মৃতি। যে স্মৃতি আনন্দের। কষ্টের। বেদনার।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন